তুরাগ থেকে মনির হোসেন জীবন
তিন অক্ষরের নাম তার ইয়াবা। মরণনেশা ইয়াবাকে বলা হয় ‘আপার ড্রাগ’। মাদক সরবরাহকারী, খুচরা বিক্রেতা ও নেশাখোরদের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাদক “ইয়াবা ট্যাবলেট”। পেশাদার নেশায় আসক্তদের উক্তি-ইয়াবা খাবি খা, মারা যাবি যা। পুরানো দিনের মাদক যেমন-হেরোইন, প্যাথেডিন, আফিম, ফেন্সিডিল, চরশ, কেরো, বাংলা মদ, গাঁজাকে ও হার মানিয়ে শীর্ষ জায়গায় রয়েছে ইয়াবা। মাদকের শহরে ভাসছে রাজধানীর উত্তরা-তুরাগ। বিশেষ করে উত্তরা বিভাগের ছয় থানা এলাকা গুলো মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। এতে করে স্থানীয় বাসিন্দা ও সর্বস্তরের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। প্রতিটি এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ভিত্তিক ইয়াবার হোম ডেলিভারি পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। বেচাকেনা চালায় তিন স্তরের সশস্ত্র সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজে বসবাসরত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত। উত্তরা বিভাগের ছয় থানায় কমপক্ষে মাদকের দু’শতাধিক হট স্পট রয়েছে। কারও কারও মতে, মাদকে সয়লাব উত্তরা বিভাগ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাদক উদ্ধারের ব্যাপারে তৎপর থাকলেও আজো পর্যন্ত বন্ধ হয়নি মাদকদ্রব্য বেচাকেনা। বরং মাদকদ্রব্য ক্রয় বিক্রিয় ও সেবনকারীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সচেতন নাগরিক ও বিশেষজ্ঞ বলছে, এবিষয়ে বর্তমান সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত । এছাড়া মাদকদ্রব্য বন্ধে প্রশাসন ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কঠোর নজরদারির ও প্রয়োজন রয়েছে।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর থেকে মাদকবিরোধী তৎপরতা ঢিলে হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উত্তরা পূর্ব, উত্তরা পশ্চিম থানার আওতাধীন নামি-দামি আবাসিক হোটেল, গেস্ট হাউজ, কিছু বস্তি এলাকা, আবাসিক উত্তরা মডেল টাউন, একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও অলিগলিতে দিনের বেলায়ই গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, দেশি-বিদেশি মদ, প্যাথেডিন, আফিম বিক্রি হচ্ছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক ভিত্তিক ডেলিভারি, মোটরসাইকেল-রিকশায় ড্রপ, রেললাইন বা খোলা মাঠে পিকআপ ভ্যানে সব মিলিয়ে লেনদেন দ্রুত ও গোপন রাখা হচ্ছে। এই বেচাকেনা চালায় তিন স্তরের সশস্ত্র সিন্ডিকেট। শীর্ষে পাইকারি সরবরাহকারী, মাঝখানে খুচরা বিক্রেতা ও সবশেষ দালাল। প্রত্যেক স্তরে দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রও রয়েছে। ‘স্পটার’ বা ‘ওয়াচার’ পথে ঘাটে কঠোর নজর রাখে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সমস্যা কিংবা অপরিচিত কেউ আস্তানায় ঢুকলেই সংকেত পাঠায়। ফলে গণমাধ্যমকর্মীদের মোবাইল কিংবা ক্যামেরা মাথার ওপরে তুললেই হামলার ঝুঁকি তৈরি হয়।
উত্তরা বিভাগের ছয় থানায় কমপক্ষে মাদকের দু’শতাধিক হট স্পট রয়েছে। সারা দেশ থেকে মাদকের চালান টঙ্গী রেলস্টেশন, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন, তেজগাঁও ও কমলাপুর রেলস্টেশনে নামে। সড়কপথে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী কালিগঞ্জ সড়ক, ঢাকা আশুলিয়া-মিরপুর বেরিবাধ সড়ক, ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে গাজীপুরের টঙ্গী, উত্তরা, তুরাগ, যাত্রাবাড়ি ও গাবতলি হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করে। এসব এলাকায় ইয়াবা, প্যাথেডিন, হেরোইন, গাঁজার বড় পাইকারি চক্র সক্রিয়, যেখান থেকে সারা দেশে সরবরাহ হয়। কোন কোন সময় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ থেকে ঢাকায় আগত বিভিন্ন নামি-দামি যাত্রীবাহী বাস ও প্রাইভেটকারে করে বড় বড় ইয়াবা ও আইচ এর চালান ঢাকায় নিয়ে আসে মাদক কারবারিরা। অনেক সময় মাদকের গডফাদার ও ডিয়াররা টাকা দিয়ে যুবক ও মাদক সরবরাহকারীদের ভাড়া করে কিংবা কন্টাক্ট করে পেটের ভেরত ইয়ারা ঢুকিয়ে বিমানযোগে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে আসে। অনেকের মাদকদ্রব্য সরবরাহের ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করে। মাঝেমধ্যে ইয়াবা ও হেরোইন ও কোকেন এর চালান ঢাকা বিমানবন্দরে ধরা পড়েছে। বিদেশী নাগরিক, রোহিঙ্গা যুবক-যুবতীসহ অনেকেই মাদকসহ ধরা পড়েছে।
মাদকের ওপর তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সুন্দরী রমনী, তরুণী ও বৃদ্ধা বয়সি মহিলাদের ব্যবহার করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এ ব্যবসায় অনেকে মাদক সম্রাজ্ঞী হিসেবে ইতোমধ্যেই বেশ পরিচিতি অর্জন করেছে। বিভিন্ন মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করে মাদক সম্রাজ্ঞীরা। এসব সম্রাজ্ঞীর একেক জনের বাহিনীতে রয়েছে। দাগি আসামিরা মাদক বেচাকেনার আলাদা আলাদা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। মাদক বেচাকেনা, চোরাচালান এবং হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ এবং একাধিক মামলা থাকলেও তারা মাদক বেচাকেনার আখড়া বসিয়ে প্রকাশ্যে ব্যবসা করছে। মাদক সম্রাট দুর্ধর্ষ এ অস্ত্রবাজদের নাম ও আখড়াগুলোর তালিকা রয়েছে পুলিশ, গোয়েন্দা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে। তবে মাদকের মূল ব্যবসায়ী ও গডফাদাররা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে, বহাল তবিয়তে।
স্থানীয় গণমানুষের অভিযোগ, উত্তরায় বেঙের ছাতার মতো আবাসিক হোটেল, গেস্ট হাউজ, মদের বার, জুয়া খেলার ক্লাব ও অসংখ্য ফ্ল্যাট বাসায় অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলে। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক দেখানো অভিযান চালানো হয়। অল্প কয়েক দিন ব্যবসা বন্ধ থাকলে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ব্যবসা আবার শুরু হয়। স্থানীয়দের মতে, অভিযানের আগে খবর ফাঁস হওয়া, মূলহোতাদের ধরা না পড়া, গুপ্ত রুটে পাল্টা চলাচল, আইনি প্রক্রিয়ায় ঢিলেমিসবই এই পুনরুজ্জীবনের কারণ। ‘স্ট্যাশ পয়েন্ট’ হিসেবে পানির ট্যাঙ্ক, পরিত্যক্ত টয়লেট, নির্মাণাধীন ছাদ, গোপন তাক, গ্যাস সিলিন্ডার গুদাম, এমনকি ড্রেন কভারও ব্যবহৃত হয়।
তথ্য অনুসন্ধান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কোথাও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে মাদকের মূল ব্যবসায়ী ও গডফাদাররা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা আত্নগোপন কিংবা বহাল তবিয়তে থাকে। কুখ্যাত মাদক সম্রাট, দুর্ধর্ষ অস্ত্রবাজ, সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজদের নাম ও আখড়াগুলোর তালিকা পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদকাসক্তদের ৫৮ শতাংশ ইয়াবাসেবী। ২৮ শতাংশ আসক্ত ফেনসিডিল এবং হেরোইনে। গবেষকরা বলছেন, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে ইয়াবা জনপ্রিয় হতে শুরু করে ২০০০ সালের পর থেকে যখন টেকনাফ বর্ডার দিয়ে মিয়ানমার থেকে এই ট্যাবলেট দেশে আসতে শুরু করে। তারপর এটি খুব দ্রুতই দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। তার আগে নব্বই এর দশকে জনপ্রিয় ড্রাগ ছিল হেরোইন।
রাজধানীতে মুক্তি নামের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের বেডের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। চিকিৎসার জন্যে তাদের কাছে যতো রোগী আসেন তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই ইয়াবাসেবী এবং মাদকাসক্ত ।
গবেষকরা বলছেন, মাদকাসক্তদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। তবে তাদের প্রকৃত সংখ্যা কতো সেটা বলা কঠিন। ইয়াবা হচ্ছে এমফিটামিন জাতীয় ড্রাগ-মেথাএমফিটামিন। হেরোইনের মতো করেই খেতে হয় ইয়াবা। ইয়াবাকে বলা হয় ‘আপার ড্রাগ’। চিকিৎসক ও গবেষকদের মতে, ইয়াবা গ্রহণ করলে শুরুতে সে শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। হেরোইন ও ফেনসিডিল হচ্ছে ইয়াবার বিপরীতধর্মী ড্রাগ। এগুলো নারকোটিক এনালজেসিক। অর্থাৎ ব্যথানাশক ওষুধ। এটিকে বলা হয় ‘ডাউনার ড্রাগ’ কারণ এটি খেলে সে ঝিম মেরে থাকে।
ডিএমপির তুরাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম দৈনিক জনতাকে জানান, তুরাগের তারারটেক গ্রামে গত শুক্রবার এক মাদক বিরোধী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় তিনি তারারটেক এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন। মাদক কারবারি যে দলেরই হউক না কেন! এব্যাপারে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না। দরকার হলে মাদকের বিরুদ্ধে এলাকা ভিত্তিক চিরুনি অভিযান চালানো হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

তুরাগ-উত্তরায় মাদক ব্যবসা জমজমাট
- আপলোড সময় : ১৫-০৯-২০২৫ ০৬:৫৮:০৫ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৫-০৯-২০২৫ ০৬:৫৮:০৫ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ